১৮৯৩ সনে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ ১২৭ বছর চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে যার সাক্ষ্য হিসেবে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল সমুহে, বাংলাদেশের মহান জাতীয় সংসদে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির বিজ্ঞ সদস্যগণ ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। ভূমিকা রয়েছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সনের এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ, হাজার ১৯৮৮ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ২০০৭ এর ওয়ান ইলেভেন সহ সকল গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্বার্থে ভূমিকা রয়েছে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি এবং চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির বিজ্ঞ সদস্যবৃন্দের।
বিগত ১০ ই ফেব্রুয়ারি ২০২০ ইংরেজি তারিখ রোজ সোমবার চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত আইনজীবী ঐক্য পরিষদ সিনিয়র সহ-সভাপতি , সহ সভাপতি, সহ-সাধারণ সম্পাদক, পাঠাগার সম্পাদক, সাংস্কৃতিক সম্পাদক, কার্যনির্বাহী সদস্যের মধ্যে প্রথম দ্বিতীয়,তৃতীয় স্থান সহ দশটি পদের মধ্যে সাতটি পদে সর্বমোট ১২ টি পদে জয়লাভ করে এবং
আওয়ামীলীগ ও মহাজোট সমর্থিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ অতি গুরুত্বপূর্ণ পদ সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, অর্থ সম্পাদক, তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক এবং কার্যনির্বাহী সদস্যের দশটি পদের মধ্যে তিনটি পদ, সর্বমোট ৭ টি পদে জয়লাভ করে।
আমি ২০১১ সাল থেকে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতিতে প্রত্যেকটি নির্বাচন অবজারভেশন করেছি। বর্তমানে বাংলাদেশ নির্বাচন ব্যবস্থা অচল বললেই চলে, যেখানে নির্বাচন হচ্ছে রাতের বেলায়, ভোট ডাকাতি ও চলছে অহরহ, সেখানে বিগত দুই এক বছর ধরে আমাদের নির্বাচনী যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে তাতে আমি চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হিসেবে নিজেকে গর্বিত মনে করি।
গত ফেব্রুয়ারি মাসের ১০ তারিখ নির্বাচন হলেও নির্বাচনের আমেজ শুরু হয়েছে মূলত গত ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে, এবং এই নির্বাচনের সমস্ত কার্যক্রম শেষ হয়েছে গত ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২০ ইংরেজী দিবাগত রাত দুইটা/তিনটার দিকে।
পরদিন সকালবেলা আমি দেখলাম আমাদের বিজয়ী নেতৃবৃন্দ একে একে বিজিত নেতৃবৃন্দ দের কে ফুল দিয়ে সম্বর্ধিত করছেন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নিচ্ছেন আবার বিজয়ী নেতৃবৃন্দ বিজিত নেতৃবৃন্দদেরকে ফুল দিয়ে সম্বর্ধিত করছেন, একই সাথে মিষ্টিমুখ করছেন, ফুল দিয়ে বরণ করছেন।
আগে শুনেছি নির্বাচনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ধরনের সংস্কৃতি বিরাজমান ছিল। কিন্তু আজ রাজনীতিতে আমরা দেখি কেউ ভিন্ন দল করলে তাকে খারাপ চোখে দেখে, মামলা হামলা দিয়ে অপদস্ত করে। গণতান্ত্রিক দেশে বর্তমানে আমরা গণতন্ত্র হীনতায় ভুগছি।
গত ১০ ফেব্রুয়ারীর নির্বাচনে জেলা আইনজীবী সমিতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী সমমনা আইনজীবী সংসদ হতে সভাপতি পদপ্রার্থী এডভোকেট মজিবুর রহমান ফারুখ স্যার নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে নির্বাচিত সকলকে অভিনন্দন জানান। আমি দেখলাম চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত নেতা সাধারণ সম্পাদক জনাব এডভোকেট আবুল হোসেন মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন স্যার তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি হতে মনোনীত বিএনপি’র চট্টগ্রাম মহানগর সহ-সভাপতি জনাব এডভোকেট আব্দুস সাত্তার সারোয়ার স্যার কে ফুল দিয়ে বরণ করার জন্য উনার চেম্বারে গেলেন এবং একই সাথে মিষ্টি মুখ করলেন যা আমি দেখে বিস্মিত হয়ে যায়।
যেখানে আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বর্তমানে বিরোধী দল করলেই তাকে নির্বাচনে পর ফুল দিয়ে বরণ অথবা সমবেদনা জানানো তো দূরের কথা তাকে মামলা দিয়ে, হামলা করে বিভিন্ন ভাবে হয়রানি করা হচ্ছে সেখানে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বারের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েও এডভোকেট আবুল হোসেন মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন স্যার ও অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার স্যারের আন্তরিকতা দেখে আমি অভিভূত,
আমি দেখলাম জামাত সমর্থিত আইনজীবী ঐক্য পরিষদ মনোনীত সহ-সাধারণ সম্পাদক পদে বিজয়ী প্রার্থী এডভোকেট মোঃ কবির হোসেনকে ফুল দিয়ে বরণ করে মিষ্টিমুখ করলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের মনোনীত পরাজিত প্রার্থী এডভোকেট আব্দুল্লাহ আল মামুন ভাই , আমি আরো দেখলাম অর্থ সম্পাদক পদে আওয়ামীলীগ সমর্থিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ হতে বিজয়ী প্রার্থী এডভোকেট মোঃ মঈনুল ইসলাম ভাই তাহার নিকট পরাজিত জামায়াত সমর্থিত আইনজীবী ঐক্য পরিষদ হতে মনোনীত প্রার্থী এডভোকেট মোঃ শহীদুল আলম সুমন ভাইকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিলেন, সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী পরিষদ মনোনীত বিজয়ী প্রার্থী অ্যাডভোকেট রুনা কাশেমকে তাহার নিকট পরাজিত প্রার্থী আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের মনোনীত প্রার্থী এডভোকেট তানজিলা মান্নান যূথী বিজয় প্রার্থী চেম্বারে গিয়ে ফুল দিয়ে বরণ করে নিলেন।
তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক পদে আওয়ামীলীগ সমর্থিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ মনোনীত বিজয়ী প্রার্থী এডভোকেট মোহাম্মদ ইমরুল হক মেননকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিলেন বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী ঐক্য পরিষদ মনোনীত পরাজিত প্রার্থী এডভোকেট মোঃ শাহাদাত হোসেন, ফুল দিয়ে বরণ করে নিলেন লাইবেরি সম্পাদক পদে পরাজিত প্রার্থী আওয়ামী সমর্থিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ মনোনীত অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যাডভোকেট হাবিবুল্লা রুমি বিএনপি বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী ঐক্য পরিষদ মনোনীত বিজয়ী প্রার্থী এডভোকেট মোঃ আলী আকবর সানজিককে সানজিককে ।
আমি দেখলাম নির্বাহী সদস্য পদে পরাজিত প্রার্থীরা বিজয়ী প্রার্থীদের কে এবং বিজয়ী প্রার্থীরা পরাজিত প্রার্থীদের কে বরণ করে নিচ্ছেন, এভাবে একে অপরকে বরণ করার ম্যাজিক সম্প্রীতি গড়ে উঠেছে তাতে আমি বাংলাদেশের সকল জেলা আইনজীবী সমিতিতে এবং আমাদের দেশের রাজনীতিতে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সকল আইনজীবী বৃন্দের আন্তরিকতা, সহমর্মিতা, জয় পরাজয় মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি চালু হওয়া দরকার বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যদি চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির মত আন্তরিকতা সহমর্মিতা জয়-পরাজয় কে মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে তবে অচিরেই আমাদের এই বাংলাদেশ সোনার বাংলাদেশ গড়ে উঠবে বলে আমি মনে করি। আমি দেখেছি চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন মানে সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত বিএনপি,জামায়াত,এলডিপির সমর্থিত আইনজীবী ঐক্য পরিষদ, আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের সমন্বয়ে আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ, গণতান্ত্রিক আইনজীবীদের সমন্বয় গণতান্ত্রিক আইনজীবী ফন্ট এবং সমমনা আইনজীবীদের সমন্বয়ে সমমনা আইনজীবী পরিষদ হিসেবে ৩/৪ দলে আমরা বিভক্ত থাকি, কিন্তু নির্বাচনের জয় পরাজয়ের মাধ্যমে ফেব্রুয়ারি মাসের ১০ তারিখের পর ১১ তারিখ থেকে আবার আমরা একদল।
আমাদের পরিচয় হয় আমরা আইনজীবী। আমরা একে অপরের বিপদে এগিয়ে আসি, তখন আর কোন দল থাকেনা, কে কোন দল সমর্থিত, কে কোন দলের নেতা কে, কোন দলের কর্মী এই ধরনের কোন দ্বিধা বিভক্ত থাকে না ।
যেহেতু বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিচারকগণ সহ বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে বর্তমানে আইনজীবিদের অধিপত্য রয়েছে এবং দুটি বড় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিতে আইনজীবীদের আধিপত্য রয়েছে, এই আইনজীবীরাই চাইলে বাংলাদেশের রাজনীতির সেই পুরাতন সংস্কৃতি ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারে। যার রোল মডেল হতে পারে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি।
আমি আশা করি চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির মত বাংলাদেশের সকল আইনজীবী সমিতি ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে জয় পরাজয় মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে উঠবে বলে আমি মনে করি।
#লেখকঃ আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী।
124,466 total views, 5 views today
Leave a Reply